উচ্চমাধ্যমিক একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনীর বাংলা প্রথম পত্রের গদ্যাংশের অন্তর্ভুক্ত একটি গল্পের নাম অপরিচিতা। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এই গল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছরই এইচএসসি পরিক্ষায় অপরিচিতা গল্প থেকে সৃজনশীল, ও এমসিকিউ প্রশ্ন আসে। আজকের আর্টিকেলে অপরিচিতা গল্পের সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর শেয়ার করা হবে। কথা না বাড়িয়ে তাহলে চলুন শুরু করি।
অপরিচিতা গল্পের সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর
তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে।
সাতাশ বছর বয়স দৈর্ঘ্যের হিসাবে বা গুণের হিসাবে— কোনো দিক থেকেই বড় নয়। তবু এর একটা বিশেষ মূল্য আছে। কেননা এই বয়সের নায়কটির ফুলের মতো বুকের উপর ভ্রমর এসে বসেছিল এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরে উঠেছে। এই বিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনাটিই তার সারাজীবনের সাথি হয়ে আছে ।
ছোটোকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন।
গল্পের নায়ক অনুপমের জীবনের মাত্র চার বছরের চমক- ইতিহাসটুকু ছোট। ছোট জলবিন্দুর মধ্যেই সিন্ধুর ব্যাপকতা থাকে, রসমাধুর্য থাকে। ওটুকু চয়ন করে নিতে হয়। এ কারণে ছোটকে যারা সামান্য বলে ভুল করেন না, তারা এর রস পান করে আনন্দ অনুভব করতে পারেন ।
আমরা যে ধনী একথা তিনিও ভোলেন না, আমাকেও ভুলিতে দেন না।
ধনী কথাটার মধ্যে এক ধরনের অহংকারবোধ যেমন আছে তেমনি অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মনোভাবও আছে। বিশেষ করে যারা গরিব থেকে হঠাৎ ধনী হয়, তাদের ক্ষেত্রে এ কথা বেশি খাটে। অনুপমের মায়ের স্বভাব ও মনোভাবের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। কারণ তিনি গরিব ঘরের মেয়ে, তাই হঠাৎ ধনী হওয়ার অহংকারটা নিজেও ভোলেন না, ছেলেকেও ভুলতে দেন না ।
তাহাকে না খুঁড়িয়া এখানকার এক গভূষও রস পাইবার জো নাই।
গোটা সংসারের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনিই জানেন কী দিয়ে কী হয়, কার জন্য কী দরকার । সংসারের সব রহস্যই তার জানা থাকে। সেই রহস্যের ছিটেফোঁটা রস উদ্ঘাটন করতে চাইলে তাকে খুঁড়তে হয়। অনুপমদের সংসারের দায়িত্ব তার মামার ওপর। তাকে না খুঁড়ে এখানকার এক গভূষও রস পাওয়ার উপায় নেই।
মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে-বস্তুত, না মানিবার ক্ষমতা আমার নাই।
গল্পের নায়ক অনুপমের বয়স যখন অল্প তখন তার বাবা মারা যান। তারপর থেকে মায়ের হাতেই সে মানুষ। মা তাকে তাঁর মনের মতো করে গড়ে তুলেছেন । তাই মায়ের আদেশ মেনে চলতেই সে অভ্যস্ত । তাঁর আদেশ না মানার মানসিক ক্ষমতা তার নেই ।
তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না ।
অনুপমের মামা শোষণ ও শাসন দুটিই ভালো বোঝেন। তিনি আত্মীয়তাও রাখতে চান অথচ তাকে যথাযথ সম্মান দিতে চান না। তিনি তার ভাগ্নের জন্য এমন ঘরের মেয়ে চান, যে এ বাড়িতে মাথা হেঁট করে আসবে। এমন বেয়াই চান, যার টাকা নেই অথচ টাকা দিতে কসুর করবে না, যাকে শোষণ করা যাবে, আবার গুড়গুড়ির পরিবর্তে হুঁকা দিলেও আপত্তি করবে না। বউ ও বেয়াই হবে তাদের বাড়ির সম্পূর্ণ অনুগত ।
সুতরাং তাহারই পশ্চাতে লক্ষ্মীর ঘটটি একেবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা হইবে না ।
হরিশের কাছ থেকে মেয়ে আর তার বাবার বৃত্তান্ত শুনে মামা খুবই খুশি। কারণ মেয়েটাই বাবার একমাত্র সন্তান। আর কেউ নেই। একসময় ধনে-মানে তাদের মঙ্গলঘট ভরা ছিল। এখন তলারটুকু ছাড়া আর কিছু নেই। মামার ধারণা, মেয়ের জন্য লক্ষ্মীর ঘটটি একেবারে উপুড় করে দিতে তার বাবা সামান্যতমও দ্বিধা করবেন না।
ভিড়ের মধ্যে দেখিলে সকলের আগে তাঁর উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা।
সুগঠিত অঙ্গসৌষ্ঠবের মানুষের প্রতি স্বাভাৱিকভাবেই অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। শম্ভুনাথ সেন সেরকম চেহারার একজন মানুষ। বিয়ের তিন দিন আগে তিনি অনুপমকে প্রথম চোখে দেখলেন এবং আশীর্বাদ করলেন। তাঁর বয়স চল্লিশের কিছু এপারে বা ওপারে। চুল কাঁচা, গোঁফে পাক ধরতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সুপুরুষ। ভিড়ের মধ্যে দেখলেও সবার আগে চোখে পড়ার মতো ।
বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক, তেজ থাকাটা দোষের।
বেহাই সম্প্রদায় বলতে কনের বাবা আর বরের বাবাকে বোঝানো হয়েছে। তাদের তেজ বা রাগ থাকাটা খুবই দোষের। তাতে দুই বেয়াইয়ের অভিমান বা জেদের ধাক্কা গিয়ে পড়ে নিরপরাধ বর-কনের উপর। দুই বেয়াইয়ের অসন্তুষ্টিতে বর-কনেও প্রভাষিত হয়। ফলে তাদের মধ্যে মনকষাকষির ব্যাপার ঘটা প্রত্যাশিত নয় ।
মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না ।
আড়ম্বরহীন বিয়েবাড়িতে ঢুকে মামা খুশি হলেন না। তার ওপর কনের বাবার টানাটানির যে কথা শুনেছিলেন, তাতে তার ধারণা হলো লোকটা ঠকাতে পারেন। তাই তিনি বেয়াই মহাশয়কে বিয়ে শুরুর আগেই গহনার মান ও মাপ যাচাই করার সুযোগ দিতে অনুরোধ করলেন। কারণ তার মতে বিয়ের পরে আর কোনো কথা তোলা যায় না। তার লক্ষ্য ছিল, তিনি কারও কাছে কোনোভাবেই ঠকবেন না ।
ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।
বরপক্ষের খাওয়া-দাওয়ার পর শম্ভুনাথ সেন তেমন ভালো আয়োজন করতে পারেননি বলে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেওয়ার ইঙ্গিত দিলে বরের মামা আশ্চর্য হয়ে বলেন যে, ঠাট্টা করিতেছেন নাকি?’ এর জবাবে শম্ভুনাথ সেন ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করার ইচ্ছা নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন । কারণ যারা মনে করে কন্যার বাবা গহনায় ফাঁকি দিবে, তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নই ওঠে না ।
মস্ত বাংলাদেশের মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাপ বিবাহের আসর হইতে নিজে ফিরাইয়া দিয়াছে।
বাংলাদেশে সাধারণত বর ও বরের বাবা কোনো কারণে কনেপক্ষের সাথে মতপার্থক্য হলে বিয়ের আসর থেকে চলে আসে অথবা কনেকে ত্যাগ করে। গল্পের নায়ক অনুপমের ক্ষেত্রেই এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। কেবল মামার অহংকারের কারণেই তার মতো ব্যক্তিত্বহীন সুপুরুষকে কন্যার বাবা বিয়ের আসর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বাহিরে তো সে ধরা দিলই না, তাহাকে মনেও আনিতে পারিলাম না।
বিনুদাদার কল্যাণে অনুপমের বিয়ের আসরটা জমজমাট হয়ে উঠল । তার এমনই দুর্ভাগ্য যে, কনে আসার আগেই বিয়ে ভেঙে গেল । বিনুদার বর্ণনায় আকর্ষিত হয়ে কল্পনার দৃষ্টিতে তাকে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হলেও তাকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগই পেল না সে। বাইরে তো সে ধরা দিলই না, তাকে মনেও আনত পারল না অনুপম ।
কিন্তু মানুষের মধ্যে যাহা অন্তরতম এবং অনির্বচনীয়, আমার মনে হয় কণ্ঠস্বর যেন তারই চেহারা।
চিরকাল কণ্ঠস্বরই অনুপমের কাছে বড় সত্য। মানুষের মধ্যে যা অন্তরতম ও অনির্বচনীয় তার দর্পণ হচ্ছে তার গলার স্বর। অনুপম তার মাকে নিয়ে তীর্থে বেরিয়েছিল। হঠাৎ একটা স্টেশনে শুনতে পেল, “শিগগির চলে আয়, এই গাড়িতে জায়গা আছে।’ বাঙালি মেয়ের গলায় বাংলা কথা যে এমন মধুর হয়, অনুপম যেন আগে কখনো শোনেনি । এই কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়েই অপরিচিতার অন্তরতম ও অনির্বচনীয় চেহারা যেন তার কাছে প্রতিভাত হলো ।
নবযৌবন ইহার দেহে মনে কোথাও ভার চাপাইয়া দেয় নাই ৷
মিষ্টি সুরে ‘এখানে জায়গা আছে’ বলা মেয়েটিকে অনুপম এইমাত্র দেখল। এখনও তাকে সুর বলেই মনে হচ্ছে। দেখতে দেখতে চোখে পলক পড়ছে না। বয়স ষোলো- সতেরো হবে। সারা দেহে নবযৌবনের আভা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তা তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলেনি অর্থাৎ তার দেহ-মনে কোথাও ভার চাপিয়ে দেয়নি। তার চলা ও বলার গতি সহজ-স্বচ্ছন্দ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, কোথাও কোনো জড়িমা নেই ।
তাহার বিশেষত্ব এই যে, তাহার মধ্যে বয়সের তফাত কিছুমাত্র ছিল না। ছোটদের সঙ্গে অনায়াসে এবং আনন্দে ছোট হইয়া গিয়াছিল।
পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী সচ্ছন্দে চলতে গেলে বয়সের তফাতটাকে ভুলে থাকতে হয়। ছোটদের সাথে মিষ্টি সুরে কথা বলার মেয়েটির সাথে ছিল আরও দু-তিনটি ছোট মেয়ে। তাদের সাথে কল্যাণী অনায়াসে ও আনন্দে ছোট হয়ে গিয়েছিল । ছেলেমানুষদের সাথে ছেলেমানুষি কথায় ও হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছিল। বয়সের তফাতটা ধরে রাখলে এই হাসি-আনন্দ কিছুতেই করা হতো না। এটা তার বিশেষত্ব, তার মধ্যে বয়সের তফাত কিছুমাত্র ছিল না । এই মনোভাবটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার ।
এখনো আশা ছাড়ি নাই, কিন্তু মাতুলকে ছাড়িয়াছি।
কানপুরে নামার সময় মেয়েটির নাম-পরিচয় জানতে পেরে অনুপম ও তার মা দুজনই চমকে উঠল। তারপর মামার নিষেধ অমান্য করে, মাতৃ আজ্ঞা ঠেলে অনুপম কানপুরে চলে এলো। কল্যাণী ও তার বাবার সাথে দেখা করে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করল। শম্ভুনাথ বাবুর হৃদয় গলল । তাতে বিশেষ কোনো ফল হলো না। কল্যাণী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে বিয়ে করবে না। বিয়ের আশায় সে মাতুলকে ছেড়েছে, তবু কল্যাণীর আশা সে এখনও ছাড়েনি।
এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি।
মায়ের সাথে যাত্রাপথে গাড়িতে ওঠার সময় কল্যাণীর কণ্ঠে প্রথম অনুপম শুনতে পায় ‘জায়গা আছে’ কথাটি। ‘জায়গা আছে’ কথাটি অনুপমের কাছে চিরজীবনের গানের ধুয়া হয়ে রয়েছে। কল্যাণীকে বিয়ে করতে পারেনি বলে অনুপমের কোনো কষ্ট নেই, বরং সুযোগ হলে তার ছোটখাটো কাজ পর্যন্ত সে করে দেয় । আর মনে মনে ভাবে, এই তো সে জায়গা পেয়েছে। যদিও তার সম্পূর্ণ পরিচয় পায়নি, আজও সে অপরিচিতা। তবুও ভাগ্য ভালো যে, সে জায়গা পেয়েছে।
আশাকরি অপরিচিতা গল্পের সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে।
আরো পড়ুনঃ আহ্বান গল্পের প্রশ্নের উত্তর